প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আগামী সাধারণ নির্বাচনে আবারও জনগণকে সেবা করার সুযোগ দিতে তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকায় ভোট চেয়েছেন। তিনি বলেন, “নৌকায় ভোট দিয়ে জনগণ দেশের স্বাধীনতা পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের উন্নয়ন হয়। জনগণের ভাগ্য পাল্টেছে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে এবং আওয়ামী লীগের সমর্থনে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।” প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আজ বিকেলে এখানে রংপুর জেলা স্কুল মাঠে বিভাগীয় মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন, যা জনসমুদ্রে পরিণত হওয়ায় অনুষ্ঠানস্থল ও এর আশপাশের এলাকাগুলো নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে মুখরিত হয়ে ওঠে । রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এই মহা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী গত সাড়ে ১৪ বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে উল্লেখ করে বলেন, “এই বদলে যাওয়া বাংলাদেশ আরো উন্নত হবে। উন্নয়নশীল দেশ, এর পরে উন্নত দেশ। ডেল্টা প্লান করে দিয়েছি। সবক্ষেত্রে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। আজকের তরুণ প্রজন্মই হবে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারাই দেশকে আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং আরো উন্নত করবে।” তিনি বলেন, একমাত্র নৌকা মার্কা ক্ষমতায় আসলেই দেশের উন্নতি হয়। কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। নৌকা মার্কায় ভোট আছে বলে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ গেছে, বাংলাদেশ এগিয়ে গেছে, এগিয়ে যাবে। কাজেই নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে আবারো আপনারা আপনাদের সেবা করার সুযোগ দেবেন। সেটাই আমি আপনাদের কাছে চাই। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে হাত তুলে প্রতিশ্রুতি দেয়ার অনুরোধ করলে, সকলে সমস্বরে দুই হাত তুলে প্রতিশ্রুতি দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার পিতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা ও ভাইদের হারানোর পর থেকে তিনি বাংলাদেশের জনগণকেই তার আপনজন বিবেচনা করেছেন এবং প্রয়োজনে দেশবাসীর জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বাবা-মা-ভাই সব হারিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের জনগণ, এটাই তো আমার সংসার, এরাই আমার আপনজন। আপনাদের মাঝেই আমি খুঁজে পাই- আমার বাবা-মা’র স্নেহ, ভাই ও বোনের ¯েœহ। কাজেই আপনাদের জন্য বাবার মত যদি প্রয়োজন হয়- এই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য বাবার মত জীবন দিতেও আমি প্রস্তুত। সেই কথাটাও আমি আপনাদের জানিয়ে দিয়ে যেতে চাই।”
প্রধানমন্ত্রী বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান। সমাবেশে, তিনি ২ হাজার কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে ২৭টি নবনির্মিত উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন এবং অন্য পাঁচটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরআগে তিনি বেলা সোয়া ১টায় হেলিকপ্টারযোগে রংপুর সেনানিবাসের হেলিপ্যাডে পৌঁছান। সেখান থেকে তাকে রংপুর সার্কিট হাউসে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তিনি রংপুর বিভাগীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ এইচএন আশিকুর রহমান সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক একেএম সায়াদত হোসেন বকুল প্রমুখ। সভায় সভাপতিত্ব করেন রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ড. দেলোয়ার হোসেন। মঞ্চে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নৌকা মার্কায় ভোট দিলে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়, সেটা আমরা প্রমাণ করেছি। আওয়ামী লীগ আমলে কোন মঙ্গা হয়নি। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে দুই হাতে টাকা পয়সা লুট করে। সে ও তার ছেলেরা মিলে এদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। ২০০৯ সালে আমরা ক্ষমতায় আসার পরে মানুষের আর কোন কষ্ট হয়নি। এ সময় বিএনপি এবং তাদের সহযোগীদের বিভিন্ন সন্ত্রাস ও অপকর্মের কঠোর নিন্দা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এখানে একটা গোষ্ঠী আছে- যারা সব সময় বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলে। জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই খেলা শুরু হয়েছিল। বার বার ক্ষমতা দখল আর হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, রাস্তায় চলন্ত বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, এরা কী মানুষের জাত ? ক্ষমতায় থাকতে লুটপাট করে খায়, আর ক্ষমতায় বাইরে থাকলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রাস্তাঘাট কেটে দিয়েছে, রাস্তার পাশের গাছ কেটেছে, আর পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করেছে। নতুন রেল কিনেছি, পুড়িয়ে দিয়েছে। বাস কিনেছি, পুড়িয়ে দিয়েছে। ওই খালেদা জিয়া ও তার কুপুত্র তারেক জিয়া জ্বালাও পোড়াও ধ্বংস করতে পারে। এরা মানুষের কল্যাণ করতে জানে না। দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে নিয়ে এখন সেই টাকা ব্যবহার করে যাচ্ছে। কোত্থেকে আসে এত বিলাসিতা! সেটাই আমার প্রশ্ন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরা এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করেছে, দেশের মানুষের টাকা আত্মসাৎ করেছে। তারেক রহমান ও স্ত্রী জোবাইদা রহমানের দুর্নীতির মামলায় এদিন আদালতের রায়ে উভয়ের ৯ বছর ও ৩ বছর করে কারাদন্ড প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের দুর্নীতির মামলাতো আমরা করিনি। তাদের প্রিয় ইয়াজউদ্দিন ফখরুদ্দিন মইনুদ্দিন করেছে। সেই মামলায় তারা শাস্তি পেয়েছে। তারা দেশ ধ্বংস করে। আমরা সৃষ্টি করি। বিএনপি-জামাত জোট ২০০১ পরবর্তি শাসনামলে আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ থেকে ৪৪ শতাংশে নামিয়ে ফেলারও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। খালেদা জিয়া কেবল উর্দ্দু আর গণিত ছাড়া সকল বিষয়ে এসএসসিতে ফেল করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, খালেদা জিয়া নিজে ফেল করা বলে ভাবে কেউ পাস করবে না। এজন্য শিক্ষার হার তারা কমিয়ে ফেলেছে। আমরা আবার উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার হার বাড়িয়েছি। আমরা বিনামূল্যে বই দিচ্ছি। কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে দিচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা অনেক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আন্দোলন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি। মানুষ শান্তিমত এখন ভোট দিতে পারে। ভোট দেয়ার জন্য আমরা ছবিসহ ভোটার লিস্ট করেছি। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স করেছি। আমাদের দরকার দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা। অনেকেই ক্ষমতায় ছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি কেউ এই রংপুরের উন্নয়নে কাজ করেনি। এই নৌকা মার্কা ক্ষমতায় আসলে কাজ হয়। নৌকা মার্কা ছাড়া হয় না। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছেন। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আজকে দারিদ্র বিমোচন হয়েছে। হতদরিদ্র মাত্র ৫ শতাংশ। এটাও থাকবে না। যারা এক বেলা খাবার পেত না, এখন দুই বেলা তিন বেলা খাবার সুযোগ হয়েছে। এদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ প্রত্যেকের ভাগ্য পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে। যার সুফল আপনারা পাচ্ছেন, দেশের মানুষ পাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী রংপুর তথা উত্তর বঙ্গের উন্নয়নের খতিয়ান তুলে ধরে রংপুর বাসীর উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি খালি হাতে আসেননি। ২৭টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৫টিা ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে রংপুর বাসীর উন্নয়ন যাতে ত্বরান্বিত হয় সেজন্য পদেক্ষেপ নিয়েছেন। তিনি বলেন, “এগুলো আমি রংপুর বিভাগের জন্য আমার উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম।” আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিটি এলাকার উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আপনাদের দীর্ঘদিনের গ্যাসের দাবি ছিলো সেজন্য বগুড়া রংপুর সৈয়দপুর গ্যাস লাইন করে দিচ্ছি। তাঁর সরকার রংপুরকে বিভাগ হিসেবে গড়ে তুলেছে এবং বিভাগীয় শহর হওয়ার জন্য যা যা সম্ভব তার সবকিছুই তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করছে এবং সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক হিসেবে গড়ে তুলছে। যাতে ভারত, ভুটান ও নেপাল ব্যবসা-বাণিজ্যে পারস্পরিক সুবিধার জন্য এটি ব্যবহার করতে পারে। তিনি বলেন, তাঁরা সৈয়দপুরে ১৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন এবং ভারতের আসাম থেকে ডিজেল আমদানির পর একটি পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, সরকার লালমনিরহাটে ২০০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। রংপুর পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, ১০০ শয্যা বিশিষ্ট শিশু হাসপাতাল ও একটি পুলিশ হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। তিনি বলেন, তারা বিখ্যাত চিলমারী বন্দর ও রংপুর সুগার মিল পুনরায় চালু করবেন এবং তিস্তা মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন করবেন। রংপুর জেলায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলায় তাঁর সরকারের উদ্যোগের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, এর ফলে এই অঞ্চলে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। রংপুর বিভাগে খাল খনন ও নদী খননের কাজ চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রামে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং লালমনিরহাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যারোস্পেস অ্যান্ড এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশের মানুষও একদিন এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে মহাকাশ ও চাঁদে যাবে এবং বিমান বানাবে।
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলায় কোন মানুষ ঠিকানা বিহিন থাকবে না’ বলে দৃঢ় প্রত্যয় পুণর্ব্যক্ত করে তাঁর সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের ভুমিহীন-গৃহহীন মানুষদের ২ কাঠা জমিসহ করে দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের পুণর্বাসনের উদ্যোগও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি এ সময় দলের নেতা-কর্মীদের নিজ নিজ এলাকায় ভূমিহীন-গৃহহীণ মানুষদের তালিকা প্রস্তুত করার আহবানও পুণরোল্লেখ করেন।
রংপুরবাসীদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “এখানকার জমি সোনার জমি। ভালো ফসল হয়। সবার কাছে আমার অনুরোধ, আমাদের মাটি আছে। উর্বর মাটি। সোনার ফসল ফলে। আমাদের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে। যে যা পারেন চাষ করবেন। আপনারা প্রত্যেকে গাছ লাগাবেন। অন্তত ৩টি করে গাছ লাগাবেন। যার যতটুকু জমি আছে, ফসল ফলাবেন। কোন জমি যেন ফেলে রাখা না হয়।” সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। উন্নত বিশ্বও হিমশিম খাচ্ছে। সব কিছুর দাম বেড়েছে। এই অবস্থায়ও তাঁর সরকার বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সমাবেশে আগত মানুষের উদ্দেশে তিনি বলেন, “এই মাঠ ছোট বলে অনেকে বহুদূরে বসে আমার কথা শুনছেন। আপনাদের চোখের দেখা দেখতে পাচ্ছি না। তবে আপনারা আছেন আমার হৃদয়ে। হৃদয় দিয়ে আপনাদের ভালোবাসা উপলব্ধি করি।”