কিশোর-কিশোরীদের জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি, তাদের জীবনমান উন্নয়ন, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার লক্ষে সারাদেশে কিশোর-কিশোরী ক্লাব গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের অধীনে ১১টি ক্লাব গঠন করা হয়। কিন্ত সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে ক্লাব গঠন করেছে নানা অনিয়ম ও দূর্নীতির কারনে শ্রীবরদীর ক্লাবগুলো তা পূরণ করতে ব্যার্থ হচ্ছে। বরাদ্দের থেকে কম টাকার নাস্তা দিয়ে ও অনুপস্থিত কিশোর-কিশোরীদের নাস্তার টাকা ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে সমন্বয় করা হচ্ছে। বরাদ্দকৃত টাকা সিংহভাগ হাতিয়ে নিয়ে অসাধু কর্মকর্তারা লাভবান হলেও, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সরকারি কোষাগার।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার ও শনিবার বিকাল ৩ টা থেকে ক্লাস শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু সময়মতো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হন না। প্রত্যেকটি ক্লাবে ৩০ জন করে সদস্য থাকার কথা। সে হিসাবে ১১টি ক্লাবের সদস্য সংখ্যা দাড়ায় ৩৩০ জন। শ্রীবরদীর উপজেলার কিশোর-কিশোরী ক্লাব গুলোর জন্য ২০২৩ সালের জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত নাস্তা বাবদ ৫ লক্ষ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার নির্দেশে ১১টি ক্লাবের নাস্তার বিষয়টি তদারিক করেন জেন্ডার প্রোমোটার শামিম মিয়া ও নূরানী আক্তার।
তথ্য অনুসন্ধান ও সরেজমিনে দেখা যায়, জানুয়ারী থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাবে ৩৫ জন করে সদস্যর জন্য নাস্তার বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু হাজিরা খাতায় দেখানো হয়েছে ৩০ জন। আবার প্রত্যেক ক্লাবের হাজিরা খাতায় ৩০ জনের নাম থাকলেও উপস্থিতি ১০-১৫ জনের বেশি নয়। পুষ্টিকর নাস্তা দেওয়ার জন্য সরকারিভাবে ৩০ টাকা করে বরাদ্দ। বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাসুমা মমতাজের। কিন্তু উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় থেকে দেয়া হয়েছে ২০ টাকার নাস্তা। বাকী টাকা ও অনুপস্থিতিদের জন্য বরাদ্দকৃত নাস্তার টাকারও কোন হিসাব নেই। কিন্তু প্রতিমাসেই বরাদ্দের পুরো টাকা অগ্রীম উত্তোলন করা হচ্ছে। পরে ভুয়া বিলভাউচার করে সমন্বয় করা হচ্ছে। অনুপস্থিতি কিশোর-কিশোরীদের নাস্তার টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত না দিয়ে একটা বড় অংশ কর্মকর্তা ও জেন্ডার প্রোমোটাররা মিলে মিশে হাতিয়ে নিচ্ছে। ২০ টাকার নাস্তার বিষয়টি ক্লাবের একাধিক শিক্ষার্থীরাও শিকার করেছে।
শ্রীবরদী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তাতিহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের নাস্তা নেওয়া হয় সুরুজ এন্টারপ্রাইজ থেকে। তিনি বলেন আমার দোকানের কোন বিল ভাউচার নেই। যে কয়টা নাস্তা নিয়ে যায় তার টাকা দিয়ে যায়। দহেরপাড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাস্তা নেওয়া হয় ক্লাবের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমানের দোকান থেকে। তারও কোন বিল ভাউচার নেই। মাটিফাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাস্তা নেওয়া হয় বড়ইকুচি বাজারের দোকানদার জিয়ার আলীর নিকট থেকে। তারও কোন বিল ভাউচার নেই। এভাবেই যে যে এলাকায় ক্লাব রয়েছে, সেই এলাকার দোকান থেকে নাস্তা নেওয়া হয়। কিন্তু উপজেলার নাস্তার সকল বিল একই দোকানের নামে করা হয়। আবার যে দোকানের নামে বিল করা হয়, সে দোকান থেকে কোন নাস্তা নেওয়া হয় না। দোকানের মালিকও জানেনা যে, তার নামে বিল ভাউচার করা হচ্ছে। মে/২৩ মাসের বিল করা হয়েছে আশা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি দোকান থেকে। দোকান মালিক হারুনের বলেন, মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ে আমার দোকান থেকে কোন নাস্তা নেওয়া হয় না। আমি কোন ভাউচার দেইনি, এমনকি কোন ভাউচারে স্বাক্ষরও করিনি। কিভাবে তারা আমার দোকানের নামে বিল ভাউচার করেছে সেটা আমার জানা নেই।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, ভাউচার সংগ্রহ করেন কিশোর-কিশোরী ক্লাবের জেন্ডার প্রোমোটার নূরানী আক্তার। একই সাথে তিনি উপজেলা ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার সাথে তার রয়েছে নিবিড় সখ্যতা। সেই সুবাদে তাকে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় থেকে ৫টি ক্লাবের নাস্তার বিষয়টি দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সঠিকভাবে দায়িত্ব না পালন করে কর্মকর্তার যোগসাজসে গোপনে ভূয়া বিল ভাউচার করে প্রতিমাসের বরাদ্দকৃত টাকার সিংহভাগ হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ভিডব্লিওবি কার্ড নিয়েও নূরানীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অভিযোগ উঠলেও কর্তৃপক্ষ অদৃশ্য কারণে নিরব ভূমিকা পালন করছে।
ক্লাবের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, যে কয়জন উপস্থিত থাকে তাদের জন্য নাস্তা দেওয়া হয়। বাকী নাস্তা কোথায় যায় আমার জানা নেই। মাটিফাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্লাবের কো-অর্ডিনেটর জেনিয়া খাতুন বলেন, ক্লাবে যে কয়জন উপস্থিত থাকে আমি তাদের নাস্তা দোকান থেকে নিয়ে আসি।
জেন্ডার প্রোমোটার নূরানী আক্তার বলেন, নাস্তা নেওয়ার জন্য উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় থেকে দোকান ঠিক করে দেওয়া আছে। আমরা সেখান থেকেই নাস্তা নেই। বিল ভাউচার সংগ্রহ করি। কিন্ত উত্তোলনকৃত অগ্রীম টাকা সমন্বয় করার জন্য বিল ভাউচার কি সেই দোকানের নামে জমা দেওয়া হয় কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন এটা আমার জানা নেই। এব্যাপারে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাসুমা মমতাজের মোবাইল নাম্বারে কল দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
শেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. লুৎফুল কবীর বলেন, আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। খোঁজ খবর নিয়ে দেখছি।
তাসলিম কবির বাবু/দেশবার্তা