শেরপুরে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-১৪। মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে র্যাব-১৪, সিপিসি-১, জামালপুর ক্যাম্পের র্যাব সদস্যরা পৃথক দুটি অভিযান চালিয়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কালু মিয়া (৪০) কে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার তাকুয়া গার্মেন্টস এর সম্মুখ থেকে ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত সাগর মিয়া (২৬) কে গাজীপুর জেলার সদর উপজেলার রাজেন্দ্রপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত কালু মিয়া শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলার বাকাকুড়া গ্রামের মৃত মজিবর রহমানের ছেলে ও সাগর মিয়া সদর উপজেলার দমদমা কালীগঞ্জ গ্রামের মো. শাজাহান আলীর ছেলে।
মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) শেরপুর জেলা শহরের মাধবপুরস্থ শেরপুর প্রেসক্লাব মিলনায়তনে র্যাব-১৪, সিপিসি-১, জামালপুর ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার আশিক উজ্জামান এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এসময় তিনি জানান, ভিকটিম কিশোরী (১৫) একজন গরীব ঘরের সন্তান। ভিকটিমের মা (বাদী) যমুনা টেক্সটাইল মিলে অপারেটর হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার প্রেক্ষিতে ভিকটিম সপরিবারে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার রতনপুর গ্রামের নুরুল বাশারের ভাড়াটিয়া বাড়ীতে বিগত ৩ বছর যাবত বসবাস করে আসছিলেন। ভিকটিম (১৫) কালিয়াকৈর রতনপুর স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলে ৫ম শ্রেণিতে পড়াশুনা করতেন। প্রতি বছরের ন্যায় রোজার ঈদের ছুটি কাটানোর উদ্দেশে সপরিবারে গত ৬/৭/২০১৬ ইং তারিখে গ্রামের বাড়ীতে যান। ঈদের ছুটি শেষে ভিকটিমকে তার নানীর কাছে রেখে ভিকটিমের মা, ভাই ও বোনসহ গাজীপুর চলে যান। ভিকটিমের মামা বিগত ২০/৭/২০১৬ তারিখে ভিকটিমের মাকে ফোন করে জানায় যে গত ১৯/৭/২০১৬ তারিখ রাত ৮টা থেকে ভিকটিমকে অনেক খোজাখুঁজি করেও পাওয়া যাচ্ছেনা। উক্ত সংবাদ শুনে ভিকটিমের মা গ্রামের বাড়ীতে চলে আসেন এবং ভিকটিমের নানীর কাছ থেকে জানতে পাবেন যে মোঃ আমান উল্লাহ ভিকটিমের বাড়ীতে এসে কথাবার্তা বলতো। সেই সুবাদে তাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে। ভিকটিমকে আসামী মোঃ আমান উল্লাহকে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তাহা প্রত্যাখ্যান করে ধর্ষণ ও হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এমতাবস্থায় আসামী কালু মিয়া ভিকটিমের সাথে কথা বলার উদ্দেশে বাড়ীতে গিয়ে ভিকটিমকে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর থেকেই ভিকটিম নিখোঁজ হয় এবং আসামী আমান উল্লাহ ও তার মা এবং কালু মিয়া পলাতক থাকে। এদিকে ভিকটিমের মা বিভিন্ন জায়গায় খোজাখুজি করে কোন সন্ধান না পেয়ে গত ২১/০৭/২০১৬ ইং তারিখ বেলা অনুমান ১০.০০ ঘটিকার সময় স্থানীয় মেম্বার জাহাঙ্গীর আলম মিস্টারকে বিষয়টি অবগত করেন। তার কিছুক্ষণ পর মেম্বারের কাছে জনৈক ফজল ফোন করে জানায় যে, জিয়ারখালে একটি লাশ পাওয়া গেছে। এই সংবাদের প্রেক্ষিতে মেম্বার ও ভিকটিমের মা পশ্চিম বাকাকুড়া গ্রামের এতিমখানার পশ্চিম পাশে জিয়ারখালে পানিতে ভাসমান একজনের লাশ দেখতে পেয়ে পানি থেকে উপরে তুলে ভিকটিমের মা তার মেয়ের লাশ সনাক্ত করেন। উক্ত লাশটি বীভৎস অবস্থায় দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে সংবাদ দিলে পুলিশ এসে ভিকটিমের সুরতহাল প্রস্তুতপূর্বক ময়না তদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে ভিকটিমের মা বাদী হয়ে এজাহার দাখিল করিলে অফিসার ইনচার্জ ঝিনাইগাতী থানায় মামলা নং ১৬/১০৫, তারিখঃ ২১/০৭/২০১৬ইং, ধারা- ৩০২/২০১/৩৪ দঃ বিঃ রুজু করেন। তদন্তকারী অফিসার মামলার তদন্ত শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৪/৯(৩)/৩০ ধারায় অভিযোগপত্র বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করেন। মামলার ঘটনার পর থেকেই আসামী কালু মিয়া আত্মগোপনে চলে যায়। দীর্ঘ ৭ বছর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কালু মিয়া দেশের বিভিন্ন স্থানে সামিউল ইসলাম নাম ধারন করে শ্রমিক এবং রাজমিস্ত্রী পেশায় নিয়োজিত ছিল। পরবর্তীতে বিজ্ঞ বিচারক, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, শেরপুর মহোদয় গত ১৮/১০/২০১৮ ইং তারিখে আসামী কালু মিয়া (৪০)’কে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ৯(৩) ধারার অপরাধে দোষী সাবস্থ করে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে আসামীর অবস্থান নিশ্চিত করে জামালপুর ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার আশিক উজ্জামান এবং সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এম. এম. সবুজ রানা এর নেতৃত্বে র্যাবের একটি অভিযানিক দল আসামীকে আটক করে। ধৃত আসামীকে ঝিনাইগাতী থানায় সোপর্দ করেছে।
অপরদিকে একই দিন র্যাব কমান্ডার আরও জানান, ভিকটিম মো. রেজ্জাক (৩৫) একজন অটোরিক্সা চালক। ভিকটিম জনৈক রেজোয়ান মিয়া ওরফে মানিক এর অটোরিক্সা ভাড়ায় চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রতিদিনের ন্যায় গত ৭/৩/২০১৬ ইং তারিখ সকাল অনুমান ৮টার দিকে মো. রেজ্জাক অটোরিক্সা নিয়ে বাহিরে যান। সারাদিন অতিবাহিত হওয়ার পর মো. রেজ্জাক রাতের বেলায় বাড়ীতে ফিরে না আসায় তার স্ত্রী ভিকটিমের ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন দিলে তার ফোনটি বন্ধ পায়। তখন ভিকটিমের স্ত্রী (বাদী) জেলখানার মোড়ে গিয়ে অন্যান্য অটোচালকদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে বাদীর ভাগিনা অটোচালক সোহাগ মিয়া জানায় যে, গত ৭/৩/২০১৬ ইং তারিখ রাত অনুমান পৌনে ৯টার দিকে মিল্টন, সাগরদ্বয় ভিকটিমের অটোরিক্সায় উঠায়া জেলখানার মোড় হতে আখের মাহমুদ বাজারের দিকে যেতে দেখেন। বাদী বিভিন্ন জায়গায় অনেক খোঁজাখুজির করার পর তার স্বামীকে না পেয়ে সদর থানায় মৌখিকভাবে ঘটনাটি জানায়। অতঃপর বাদী ও পুলিশসহ খোঁজাখুজির একপর্যায়ে দমদমা কালিগঞ্জ সাকিনস্থ করিম মাস্টার এর বসতবাড়ীর পেছনে কবরস্থানে ভিকটিমের অটোরিক্সাটি রক্তমাখা অবস্থায় দেখতে পায়। বাদী এবং পুলিশসহ আসামী মিল্টন এর বাড়ীতে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে বাড়ীর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজির একপর্যায়ে আসামীর বসতঘরের চৌকির নীচ হতে তার পরিহিত শার্ট, প্যান্ট ও জুতা রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরে বাদীর সন্দেহ আরো ঘনীভূত হতে থাকলে থানা পুলিশসহ ভিকটিমকে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুজি করতে থাকে। এমতাবস্থায় স্থানীয় লোকজনের সংবাদ প্রাপ্তির পর ভিকটিমের স্ত্রী গত ৮/৩/২০১৬ ইং তারিখ সকাল সোয়া ৭টার দিকে মোবারকপুর সাকিনস্থ জনৈক আলহাজ্ব মোহাম্মদ আলী এর ইটের ভাটার ভিতরে ইট দ্বারা অর্ধ ঢাকা অবস্থায় ভিকটিমের কপালে কাটা দাগ, গলা কাটা ও ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ব্যতীত চারটি আঙ্গুলের মাঝখানে কাটা রক্তাক্ত অবস্থায় লাশ সনাক্ত করে। উক্ত লাশটি বীভৎস অবস্থায় দেখে স্থানীয় লোকজন পুলিশকে সংবাদ দিলে পুলিশ এসে ভিকটিমের সুরতহাল প্রস্তুতপূর্বক ময়না তদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে ভিকটিমের স্ত্রী বাদী হয়ে এজাহার দাখিল করিলে অফিসার ইনচার্জ শেরপুর সদর থানায় মামলা নং-০৮/১০২, তারিখঃ ৮/৩/২০১৬ ইং, ধারা-৩০২/৩৭৯/২০১/৩৪ দঃ বিঃ রুজু করেন। তদন্তকারী অফিসার মামলার তদন্ত শেষে আসামীদের বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালের পেনাল কোড আইন এর ৩০২/৩৭৯/২০১/৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র বিজ্ঞ আদালতে দাখিল করেন। মামলার ঘটনার পর থেকেই আসামী সাগর মিয়া আত্মগোপনে চলে যায়। দীর্ঘ ৬ বছর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় সাগর দেশের বিভিন্ন স্থানে মোঃ শাহীনুর নামে ইসলামী ব্যাংক, রাজেন্দ্রপুরে সিকিউরিটি গার্ড পরিচয়ে চাকুরী করেন এবং সিএনজি চালক ইত্যাদি পেশায় জীবনযাপন করত। পরবর্তীতে বিজ্ঞ বিচারক, জেলা ও দায়রা জজ, আদালত শেরপুর মহোদয় গত ৬/৪/২০২২ ইং তারিখে আসামী সাগরকে ১৮৬০ সালের পেনাল কোড আইন এর ৩০২/৩৭৯/২০১/৩৪ ধারার অপরাধে দোষী সাবস্থ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে ও ১০০০০/- টাকা অর্থ দন্ড এবং অনাদয়ে আরো তিন মাসের কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে আসামীর অবস্থান নিশ্চিত করে জামালপুর ক্যাম্পের কোম্পানী কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার আশিক উজ্জামান এবং সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার এম. এম. সবুজ রানার নেতৃত্বে র্যাবের একটি অভিযানিক দল ২৪ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাতে গাজীপুর জেলার সদর থানাধীন রাজেন্দ্রপুর এলাকা হতে আসামীকে আটক করে। ধৃত আসামীকে শেরপুর সদর থানায় সোপর্দ করেন।
প্রেস ব্রিফিংয়ে শেরপুর প্রেসক্লাব সভাপতি মো. শরিফুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মো. মেরাজ উদ্দিন, সাবেক সভাপতি এডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাবিহা জামান শাপলা, জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা শেরপুর জেলা ইউনিটের সভাপতি আছাদুজ্জামান মোরাদ, সাধারণ সম্পাদক জিএইচ হান্নানসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণ উপস্থিত ছিলেন।
হামিদুর/দেশবার্তা