শেরপুরে ‘স্বচ্ছতা, জবাবদিহীতা ও আমাদের মনোগঠন: ব্যক্তি ও পরিবার’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পারিবারিক বাজেট এবং আর্থিক ও সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা এবং এ সংক্রান্ত একটি গাইড লাইন অনুশীলন করা হয়। নাগরিক প্ল্যাটফরম জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটির আয়োজনে শনিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে শেরপুর সরকারি কলেজ মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত এক গবেষণা জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
জরিপে উঠে এসেছে, দেশের ৯৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ নাগরিক দৈনন্দিন খরচের হিসাব লিখে রাখেন না। ৯৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই খরচ করেন। এছাড়াও ৮৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের নাগরিক নিয়মিত কোনও সঞ্চয়ই করেন না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ইসতিয়াক রায়হান বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইইডি)’র সহায়তায় ২০২২ সালের ১৫ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এ জরিপ কাজটি পরিচালনা করেন। এতে ঢাকা, ময়মনসিংহ ও যশোরের ১৫০ জন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ অংশগ্রহণ করেন। গত ২৬ জুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ওই গবেষণা জরিপটির ফলাফল উপস্থাপন করেন। দৈনন্দিন নাগরিক জীবন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গবেষণা জরিপে উঠে এসেছে, ৯৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী প্রতিদিনের কাজে কোনও রুটিন মেনে চলেন না। ব্যক্তিগত কাজের সময়ের ব্যবহার নিয়ে ৯০ ভাগই সন্তুষ্ট না। মাত্র ১০ ভাগ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ তার এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন বা পাসপোর্ট ও সনদে নিজের ব্যক্তিগত তথ্য মিলিয়েই দেখেননি। ২৮ শতাংশ বলেছেন, তথ্য ঠিক আছে এবং ১২ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের ব্যক্তিগত তথ্যে ভুল আছে।
জরিপ রিপোর্টের গবেষণার ভিত্তিতে গবেষক ইসতিয়াক রায়হান ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ, সময় ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিগত তথ্য সব জায়গায় সঠিকভাবে সংরক্ষণ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে সঞ্চয় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গবেষক রায়হান পারিবারিক বাজেট এবং ব্যক্তি ও পরিবারের আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ, আর্থিক ও সময় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করেছেন।
জনউদ্যোগ শেরপুর কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষক মো. আবুল কালাম আজাদ-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সদস্য সচিব সাংবাদিক হাকিম বাবুল জরিপ রিপোর্টটি পাঠ করে শুনান এবং পরবর্তীতে গাইডলাইনটি উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা অনুশীলন করেন।
মতবিনিময় সভায় জনউদ্যোগ কমিটির সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্য, যুব ও নারী ফোরাম সদস্য সরকারী কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সংস্কৃতি কর্মী, সাংবাদিক সহ অর্ধশতাধিক সুধীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
অন্যান্যের মাঝে অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া, জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুর রৌফ লাভলু, জেলা জজ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত নাজির রাশিদুজ্জামান রিন্টু প্রেসক্লাব সভাপতি মো. শরিফুর রহমান, নারী নেত্রী আঞ্জুমান আরা যুথী, শিক্ষিকা করুণা দাস কারুয়া, পুরোহিত কমল চক্রবর্তী, উদীচী জেলা সভাপতি তপন সারোয়ার, শিক্ষক এসএম আবু হান্নান, নৃ-জনগোষ্ঠির নেতা সুমন্ত বর্মন, যুবনেতা শুভংকর সাহা প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।
শিক্ষক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা রাষ্ট্রের বাজেট নিয়ে চিন্তা করি, অপরের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতার নিয়ে মাথা ঘামাই, সমালোচনা করি। কিন্তু আমরা কখনোও ব্যক্তি ও পরিবারের বাজেট এবং নিজেদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিয়ে খুব একটা সচেতন নই। কার কতো আয়, কতো ব্যয়, এর সঠিক হিসাব আমরা পরিবারে মধ্যেও আলোচনা করি না, রাষ্ট্রকেও ঠিকমতো হিসাব দেই না। এটা আমাদের মনোগঠনের এক বিরাট সমস্যা। এজন্য আমাদের মনোজগতের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আগে ব্যক্তির নিজের ও পরিবারের মধ্যে এসব বিষয়ের চর্চা করতে হবে। ব্যক্তি ও পরিবারের বাজেট ঠিক হলে, রাষ্ট্রের বাজেটও ঠিক হবে এবং দূর্নীতি, অনিয়ম কমবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া বলেন, জনউদ্যোগের এই সভা এক নতুন সমাজ গঠনে পথনির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে, উপস্থিত সকলের মাঝে চিন্তার জগৎ ও ধারণাগত পরিবর্তন আনবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ আলোচনাগুলো সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য যে যার যার অবস্থান থেকে আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আব্দুর রৌফ লাভলু, আমরা যে পারিবারিক বাজেট করিনা, তা কিন্ত নয়। আমরা অবশ্যই আয় বুঝে ব্যয় করে থাকি। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে আকস্মিক ঘটনায় হিসাবে উলট-পালট হয়ে যায়। তবে আজকে যেভাবে ফরমেট অনুযায়ী আয়, ব্যয় ও সঞ্চয়ের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে, সেটি অনুসরন করতে পারলে আশাকরি ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে। উপস্থিত সকলেই এ আয়োজনটির ভুয়সী প্রশংসা করেন।
হামিদুর/দেশবার্তা