বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে চলাফেরা করেন সাফিয়া খাতুন। বয়স হয়েছে ৮৩ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণে নানা রোগে-শোকে ভুগছেন দীর্ঘদিন। চিকিৎসা দূরের কথা, তিন বেলা খাবার জোটানোও তাঁর জন্য কষ্টকর। জীবনের শেষ সময়ে একটু সচ্ছলতার আশায় বয়স্ক ভাতার কার্ডের জন্য ধরনা দিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে। সাবেক এক ইউপি সদস্যকে ৪ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে আশ্বাস মিললেও জোটেনি কোনো কার্ড।
সাফিয়া খাতুনের বাড়ি শেরপুর জেলার সদর উপজেলার চরশেরপুর ইউনিয়নের দড়িপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তাঁর জন্ম তারিখ ১৯৩৮ সালের ২ ডিসেম্বর। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, বয়স্ক ভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর বয়স সর্বনিম্ন ৬২, আর পুরুষের বয়স সর্বনিম্ন ৬৫ বছর। সে অনুযায়ী সাফিয়া বয়স্ক ভাতা পাওয়ার যোগ্য হলেও, পাননি কারও সহযোগিতা।
এলাকাবাসী ও স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাফিয়ার স্বামী আব্দুল জলিল মারা গেছেন প্রায় ৮ বছর আগে। সহায়-সম্পদ বলতে একখণ্ড বাড়িভিটা ছাড়া তাঁর তেমন কিছু নেই। সংসার জীবনে ছেলে, মেয়েরা যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বৃদ্ধ, অসহায় মায়ের কথা কেউ ভাবেননা। তাই এই ৮৩ বছর বয়সে কখনো একবেলা, কখনো না খেয়ে থাকতে হয়। এছাড়াও বয়স বেশী হওয়ায় প্রায়ই অসুস্থ থাকেন সাফিয়া। তাই চিকিৎসার জন্য হাত পাততে হয় মানুষের কাছে।
সাফিয়া খাতুন বলেন, আমার স্বামী মইরা গেছে ৮ বছর অইবো। উনি মারা যাওয়ার পর আমি ছেলের কাছে থাকতাম। কিন্তু ছেলের বউ খালি আমার সাথে ঝগড়া করে। তাই অনেকদিন অইলো, ছোট একডা ঝুপড়ি ঘরে একলাই থাহি। তিনি আরও বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর ম্যালা কষ্টে আছি। অসুখ অইলে ঠিকমতো ওষুধ কিনবার পারি না। একটু খাইয়া-পইরা চলার জন্য ম্যালা দিন চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে গেছি। কেউ আমারে সাহায্য করে নাইক্যা। সবশেষ একজনের কাছ থাইক্যা ৪ হাজার ট্যাহা ধার কইরা কহিনুর মেম্বাররে দিছি। ট্যাহা পাইয়াও সে তার কতা রাহে নাই। পরে ম্যালা বিচার, সালিশ কইরা ট্যাহা কয়ডা ফেরত পাইছি।
স্থানীয় এলাকাবাসী এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, এই বৃদ্ধ বয়সে সাফিয়া অনেক কষ্ট করছেন। উনার ছেলে মেয়েরা তার খোঁজ নেয় না। অনেক সময় ক্ষুধার জ্বালায় লোক লজ্জা ভেঙ্গে সাফিয়া মেয়ের শশুর বাড়িতে হাজির হন। শুধুমাত্র একবেলা খাওয়ার জন্য। তিনি বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে গেছেন। কোথাও চলাফেরা করতে গেলেও তো রিকশা ভাড়া লাগে। তার তো সেই সামর্থ্যও নেই। অসুস্থ হলে বিছানায় পরে থাকেন। ডাক্তার দেখাবে, ঔষধ কিনবে, সেটাও তিনি পারেন না। তাই বয়স্ক ভাতার কার্ডটা হলে উনার খুব উপকার হতো।
চরশেরপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য নিজের প্রতি আনা অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, সেদিন আমি বাড়ি ছিলাম না। বৃদ্ধা সাফিয়া জোর করে আমার স্ত্রীর কাছে বয়স্ক ভাতা কার্ড করে দেওয়ার জন্য ৪ হাজার টাকা দিয়ে আসে। তাহলে টাকা দিতে বিচার, সালিশ করতে হলো কেন ? সেই প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এই ইউপি সদস্য বলেন, টাকাটা আমি খরচ করে ফেলেছিলাম।
এব্যাপারে চরশেরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সেলিম রেজা বলেন, আমি নতুন পাশ করে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছি। এত বয়সী একজন বিধবা নারীর যে বয়স্ক ভাতার কার্ড হয়নি। সেটা আমি জানতাম না। আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি আমার কাছে আসেননি। এবিষয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে কথা বলে তাঁর জন্য একটি বয়স্ক ভাতার কার্ড ব্যবস্থা করবো। এছাড়া আমার ইউনিয়নে যদি এরকম সাফিয়ার মতো আরো কেউ বয়স্ক ভাতা কার্ড থেকে বঞ্চিত থাকে। তাদের প্রত্যেককে সেটির ব্যবস্থা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে করে দেওয়া হবে।
এবিষয়ে শেরপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মেহনাজ ফেরদৌস বলেন, ওই বিধবা বৃদ্ধা সাফিয়া সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে আবেদন করলে তদন্ত সাপেক্ষে তাঁর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বয়স্ক ভাতা পাওয়ার মতো উপযুক্ত হলে তাঁকে অবশ্যই কার্ড করে দেওয়া হবে। এটার জন্য তাকে অন্য কোথাও হয়রানি হতে হবে না।
জাহিদুল খান সৌরভ/দেশবার্তা